ঘাড়ের হাড়, পেশি এবং লিগামেন্টসমূহ আমাদের মাথার ভার বহন করে এবং তার চলন নিয়ন্ত্রণ করে। এই অংশগুলোতে যেকোনো অস্বাভাবিকতা, প্রদাহ বা আঘাত হয়ে উঠতে পারে ঘাড় ব্যথার কারণ। ঘাড়ের ব্যথার লক্ষণগুলোর তীব্রতা এবং স্থায়িত্বকাল এক এক রকম। প্রায়শই, ঘাড়ের ব্যথা সহনশীল পর্যায়ের হয় এবং মাত্র কয়েক দিন বা সপ্তাহ স্থায়ী হয়।
অনেকগুলো কারণ রয়েছে:-
১. রাতে ঘুমানোর সময় যে বালিশ ব্যবহার করি সেটি যদি ঠিকমত ব্যবহার না করি। যেমন- অনেকে উঁচু বালিশ ব্যবহার করেন, কেউ নিচু বালিশ ব্যবহার করেন আবার কেউ একের অধিক অতিরিক্ত বালিশ ব্যবহার করেন। তাদের ক্ষেত্রে ঘুম থেকে উঠার পর অনেক সময় ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে।
২. ভুল ভঙ্গিতে শোয়ার কারণেও ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে।
৩. একটানা একইভাবে বসে টেলিভিশন দেখার কারণে হতে পারে।
৪. যারা দীর্ঘসময় ধরে ঘাড় নুইয়ে কম্পিউটার বা ল্যাপটপে কাজ করেন তাদেরও ঘাড়ে ব্যথা হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
৫. শিক্ষার্থী যারা একটানা ঘাড় নুইয়ে লেখাপড়া করেন তাদেরও এই সমস্যা হতে পারে।
৬. শুয়ে-বসে কিংবা অনেকক্ষণ ধরে ঘাড় নুইয়ে মোবাইল দেখা, গেমস খেলা বা বিভিন্ন কাজ করে থাকেন অনেকে। তাদেরও অনেক সময় ঘাড়ে ব্যথা হয়ে থাকে।
৭. যারা গৃহস্থালির কাজ করেন, যেমন কাপড় ধোয়া, তরকারি কাটা বা ঘাড় নুইয়ে বিভিন্ন কাজ করেন তাদেরও এই সমস্যা হতে পারে।
৮. ঘাড়ে কোনো সময় আঘাত পেলে সেখান থেকেও ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে।
৯. কেউ যদি দুঃশ্চিন্তা, হতাশায় ভোগেন অর্থাৎ কোনো কারণে যদি অতিরিক্ত মানসিক চাপে ভোগেন তাহলেও ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে।
১০. মাত্রাতিরিক্ত ব্যায়াম করার কারণেও অনেক সময় ঘাড়ে ব্যথা হয়।
১১. হঠাৎ করে ভারি জিনিস ঘাড়ে নেওয়া অথবা হাতে অতিরিক্ত ওজন বহন করার কারণে পরে ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে।
চিকিৎসা:-
ব্যথানাশক ওষুধ
ব্যথা থেকে তাৎক্ষণিক মুক্তির জন্য ব্যথানাশক ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। কখনো কখনো ব্যথা নিবারণের জন্য ইনজেকশনের প্রয়োজন হয়। ব্যথা কমানোর পর প্রকৃত চিকিৎসা প্রদান করা হয়।
* গরম সেক
যখনই অস্থিসন্ধি বা হাড়ের গিরাতে ব্যথা হয়, গিরার চারপাশের মাংসপেশিগুলো শক্ত হয়ে ওঠে এবং প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসাবে গিড়ার সচলতা কমিয়ে দেয়। মূলত পেশির সংকোচনের দ্বারা প্রাকৃতিকভাবে শরীর প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেয়-এটাই আমরা করে থাকি সার্ভাইক্যাল কলার পরে। কিন্তু মাংসপেশির সংকোচন বা টান যখন বেশি হয় তখন ব্যথা সৃষ্টি হয়। তাপ হলো মাংসপেশিকে শিথিল করতে সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা। এ কারণে পেশিতে গরম সেঁক দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে হট ওয়াটার ব্যাগ, ইলেকট্রিক্যাল হিটিং প্যাড কিংবা ইনফ্রারেড ল্যাম্প ব্যবহার করা যেতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয় গোসলের সময় ঘাড়ে গরম পানি ঢাললে। অধিক পছন্দনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা শর্ট ওয়েভ ডায়াথার্মি ও আলট্রাসাউন্ড হিট। এগুলো ফিজিওথেরাপিস্টরা দিয়ে থাকেন।
* ট্রাকশন
ডিস্ক সরে গিয়ে স্নায়ুমূলে চাপ সৃষ্টি করলে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ট্রাকশন সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা। ট্রাকশনের ফলে দুই কশেরুকার মধ্যবর্তী স্থানগুলো বৃদ্ধি পায় এবং এ কারণে স্নায়ুমূলের ওপর ডিস্কের চাপ শুরু হয়। ট্রাকশনের ওজন বাড়ানো কিংবা কমানো নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর। বসে ট্রাকশন দেওয়া যেতে পারে কিংবা শুয়েও দেওয়া যেতে পারে। শোয়া অবস্থায় ট্রাকশন দিলে মাথার দিকের খাট ব্লক দিয়ে ৬-৯ ইঞ্চি উঁচু করে রাখতে হবে। ট্রাকশনের ফলে ব্যথা বেড়ে গেলে ট্রাকশন বন্ধ করে দিয়ে কোনো ত্রুটি আছে কি না তা পরীক্ষা করে সংশোধন করতে হবে।
* মালিশ বা ম্যাসাজ
ঘাড়ের টানটান পেশিগুলোকে শিথিল করতে মালিশ অত্যন্ত কার্যকর ব্যবস্থা। তবে ম্যাসাজ বা মালিশ করার সময় খেয়াল রাখতে হবে এসব যেন উলটাপালটা করা না হয়। দুই কাঁধে এবং ঘাড়ের মালিশ করতে হবে ধীরে ধীরে। মাংসপেশিকে জোরে মুচড়ে দেওয়া যাবে না, তাতে ক্ষতি হবে।
* ঘাড়ের মাংসপেশি শক্তিশালী করে তোলা
ঘাড়ের মাংসপেশি দুর্বল হয়ে পড়লে মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু পেশিগুলো যদি শক্তিশালী থাকে তাহলে মেরদণ্ডের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে না, ফলে মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। কিছু ব্যায়ামের মাধ্যমে ঘাড়ের মাংসপেশিকে শক্তিশালী করা যায়। তবে এসব ব্যায়াম করতে হবে প্রাথমিক ব্যথা মিলিয়ে যাওয়ার পর।
* হাত দুটি একসঙ্গে করে মাথার সামনে ঠেকিয়ে মাথাটাকে সামনের দিকে চাপ দিতে হয়। হাতের ওপর মাথার চাপ বাড়বে, তবে হাত দুটিও মাথার ওপর সমান চাপ দেবে।
* হাত দুটি মাথার পেছনে নিয়ে মাথাটাকে পেছন দিকে চাপ দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে হাত দুটি যেন মাথার সামনে চাপ দেয়।
* একইভাবে ডান হাত দিয়ে মাথার ডান দিকে ও বাম হাত দিয়ে মাথার দিকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। মাথাও সমানভাবে হাতের ওপর চাপ দেবে।
মূলত হাত ও মাথার পরস্পরের দিকে চাপ এমন হতে হবে যেন মাথা বাঁচিয়ে যেতে না পারে। অর্থাৎ হাত যত জোরে মাথার দিকে চাপ দেবে, মাথাটাকে তত জোরে বিপরীত দিকে ঠেলতে হবে।
* শক্ত পেশি শিথিল করতে ব্যায়াম
প্রাথমিক ব্যথা সেরে যাওয়ার পর সার্ভাইক্যাল স্পনডাইলোসিসের রোগীরা শক্ত ঘাড়, পিঠের উপরি অংশ ও কাঁধের পেশি শিথিল করতে কিছু ব্যায়াম করতে পারেন-
* মাথাটাকে বামে ও ডানে ঘোরান।
* মাথাটাকে বাঁচিয়ে সামনের দিকে আনবেন। তারপর পেছনের দিকে নেবেন।
* মাথাটাকে ঘড়ির কাঁটার দিকে এবং ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে ঘোরাবেন।
* কাঁধ দুটি ওপরের দিকে তুলবেন ও নামাবেন। তারপর কাঁধ দুটিকে ঘোরাবেন।
* হাত দুটিকে নিজের দুই কাঁধের ওপর স্থাপন করে কনুই দুটি বৃত্তাকারে ঘুরাবেন।