কোমর ব্যথা এ পৃথিবীর প্রায় সব মানুষেরই একটি সাধারণ সমস্যা। দুনিয়ার এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন, যার জীবনে অন্তত একবার কোমর ব্যথার অভিজ্ঞতা নেই। মেরুদন্ডের মাংসপেশি, লিগামেন্ট, স্নায়ু, হাড়, জোড়া, তরুণাস্থি বা ডিস্কের জটিল যোগাযোগ বিন্যাসের বিভিন্ন প্রকার সমস্যার জন্য কোমর ব্যথা হয়ে থাকে।
কোমর ব্যথার কারণ:-
১. যারা অফিসে দীর্ঘক্ষণ বসে একই ভঙ্গিতে কাজ করেন।
২. বসার চেয়ার টেবিল ঠিকমতো না হলে বা ঠিকমতো না বসলে বা সামনে-পেছনে ঝুঁকে বসলে একই কারণে কোনো সময় কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
৩. দীর্ঘক্ষণ ড্রাইভিং করলে বা বেশি সামনে ঝুঁকে গাড়ি চালালে কোমর ব্যথা হতে পারে।
৪. যারা শুয়ে বা কাত হয়ে বই পড়েন বা সোফায় শুয়ে টিভি দেখেন বা অন্য কাজ করেন।
৫. অনেকেই আছেন যারা কোনো ভারী জিনিস সঠিক নিয়মে তোলেন না। ফলে মেরুদণ্ডে অস্বাভাবিক চাপ পড়ে এবং তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ব্যথা হয়।
৬. অস্বাভাবিক পজিশনে ঘুমানোর কারণে অনেকেই ব্যথায় আক্রান্ত হতে পারেন।
৭. আঘাত জনিত কারণে ব্যথা হতে পারে।
৮. যারা বয়োবৃদ্ধ আছেন তাদের দীর্ঘদিন ধরে শরীর নাড়াচাড়া বা জয়েন্টস একই অবস্থায় থাকতে থাকতে মাংশপেশী শিকিয়ে যায়, জয়েন্টসগুলো শক্ত হয়ে স্নায়ুর উপর চাপ বৃদ্ধি করে ফলে ব্যথা হয়।
৯. এছাড়াও অস্টিওপোরোসিস বা হাড় ক্ষয় রোগ। যাতে আমাদের শরীরের হাড়গুলো ক্যালসিয়াম ধরে রাখতে পারে না। যে কারণে হাড়গুলো নরম ও ভঙ্গুর হয়। আবার এতে আমাদের দুই কশেরুকার মাঝে যে নরম জেলির মতো পদার্থ থাকে বা ইন্টারভারটিব্রাল ডিস্ক থাকে তার উপর চাপ পড়ে। সেটা আবার আমাদের শরীরের দুই পাশের ব্যথা নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ুর ওপর চাপ বাড়ায় এবং কোমরে ব্যথা হতে পারে।
কাদের বেশি হয়?
১. কোমরে ব্যথা সাধারণত বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে। বেশি দেখা যায় ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সের পর থেকে।
২. কায়িক শ্রমের অভাব বা নিয়মিত ব্যায়ামের অভাবে পেট ও পিঠের মাংসপেশি চাপ ধরে যায়। ফলে একটু পরিশ্রমেই ব্যথা হতে পারে।
৩. অতিরিক্ত ওজনের কারণে কোমরের মাংসপেশি এবং হাড়ের ওপর চাপ পড়ে। ফলে ব্যথা হতে পারে।
৪. অনেক সময় কিডনিতে পাথর হলে বা প্রস্রাবে ইনফেকশন হলেও কোমরে ব্যথা হতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে শুধু কোমরে ব্যথাই না, অন্য আরো অনেক উপসর্গও থাকবে। তাই কোমরে ব্যথা হলেই সেটা কিডনি স্টোন বা ইউরিন ইনফেকশন নয়।
৫. ডিপ্রেশন বা স্ট্রেমের কারণেও কোমরে ব্যথা হতে পারে।
৬. মদ্যপান এবং স্মোকিং-এর কারণেও কোমরে ব্যথা হয়। স্মোকিং-এর কারণে রক্তনালী চিকন হয়ে যায় এবং কোমর থেকে নিচের দিকে ঠিকমত রক্ত প্রবাহ হয় না। যার ফলে হাড় ঠিকমত পুষ্টি পায় না এবং দুর্বল হয়ে পড়ে।
৭ অস্টিও পোরোসিসের কারণে অনেক মাঝ বয়েসী নারীদের মাজায় ব্যথা হতে পারে।
কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন ?
সব সময় ধরে বা জমে আছে—এ ধরনের ব্যথা।
ভারী ওজন তোলা বা অতিরিক্ত কাজের পর তীক্ষ্ণ ব্যথা।
কোমর থেকে নিতম্ব, ঊরু ও পায়ের আঙুল পর্যন্ত ব্যথা বিস্তৃত হলে।
পায়ে দুর্বলতা বা অবশ ভাব হলে।
হাঁচি, কাশি দিলে বা সামনে ঝুঁকলে ব্যথা বেড়ে যায়।
প্রস্রাব বা পায়খানার নিয়ন্ত্রণ না থাকলে।
শোয়া অবস্থায় বা শোয়া থেকে ওঠার সময় ব্যথা হলে।
চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমরা দুটি পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারি
১. প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
২. ব্যথা পরবর্তী চিকিৎসা
প্রতিরোধ মুলক ব্যবস্থা:
১. দীর্ঘক্ষণ আমরা একই ভাবে বসে না থেকে ৫-১০ মিনিট বিরতি নিতে পারি। এই সময়ে আমি নিজ অবস্থানে বসে শারীরিক কিছু হালকা ব্যায়াম করে নিতে পারি যা আমাদের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় যেমন মাংশপেশী, জয়েন্টস ও মেরুদণ্ডে রক্ত চলাচল বাড়বে ও এদের অতিরিক্ত চাপ নেয়ার জন্য প্রস্তুত হবে।
২. নিয়মিতভাবে আমাদের বিভিন্ন জায়গার মাংশপেশীর জন্য নির্ধারিত কিছু ব্যায়াম আছে যা করতে পারি। এসকল ব্যায়ামে বেশি সময় প্রয়োজন হয় না। নিয়মিতভাবে ৫-১০ মিনিট সময় দেয়ার মাধ্যমে আমরা এসকল ব্যায়াম করতে পারি। এতে আমাদের শরীরের মাংশপেশী ও জয়েন্টস অতিরিক্ত চাপ নেয়ার জন্য প্রস্তুত হবে।
৩. ঘুমানোর ক্ষেত্রে খুব সুন্দর কিছু নিয়ম আছে যা মেনে আমরা খুব সহজেই শরীরের ঘাড়, মাথা ও কোমরের ব্যথা থেকে বেঁচে থাকতে পারি।
৪. আমাদের বাসায় যারা খুবই বয়োবৃদ্ধ তাদের দিনের কোনো এক সময় অন্য কেউ একজন শরীরের বিভিন্ন মাংশপেশী ম্যাসেজ ও জয়েন্টসগুলো নাড়াচাড়া করিয়ে দিতে পারি। এতে করে তাদের স্নায়ুর ওপর চাপ কম হয় এবং ব্যথা কম থাকে বা আসে না।
৫. অভ্যাস না থাকলে মাত্রাতিরিক্ত ওজন বহন করা থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে আমাদের মাংশপেশী, লিগামেন্টস, জয়েন্টস ও মেরুদণ্ডের ওপর অতিরিক্ত চাপের কারণে ইনজুরি থেকে ভালো থাকতে পারি।
৬. অস্টিওপোরোসিস রোগের জন্য যারা ঝুঁকিতে থাকেন যেমন মাঝ বয়েসী মহিলা, ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি, যাদের ওজন অতিরিক্ত তারা যথা সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে জীবনযাপন পদ্ধতি ও খাদ্যাভ্যাস মেনে চলতে পারেন।
ব্যথা পরবর্তী চিকিৎসা পদ্ধতি:
এই চিকিৎসা পদ্ধতি আমরা কয়েকটি স্তরে নিত পারি।
১. মেডিক্যাল চিকিৎসা ও ফিজিওথেরাপি।
২. ইন্টারভেনশনাল থেরাপি।
৩. কগনিটিভ বিহ্যভিয়রাল থেরাপি বা জীবন যাপন পদ্ধতি পরিবর্তনমূলক কাউন্সেলিং
৪. অপারেশন।
মেডিক্যাল চিকিৎসা
মেডিক্যাল চিকিৎসার ক্ষেত্রে কয়েকটি কথা বলে নেয়া খুবই জরুরি। ব্যথার জন্য অনেকেই বিভিন্ন সময় নিজেদের ইচ্ছামতো ঔষধ কিনে খান। ব্যথার জন্য ব্যাবহার হয় এমন অনেক ঔষধ (NSAID) দীর্ঘদিন ধরে বা অনিয়ন্ত্রিত ভাবে খেলে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। প্রেশার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এছারাও রক্ত ক্ষরণজনিত সমস্যা হতে পারে। সেজন্য অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নিরাপদ ঔষধ খাওয়া উচিত। আর চিকিৎসা নেয়ার সময় অবশ্যই আপনার পূর্বে থেকে কোনো অসুখ বা ঔষধ খেয়ে থাকলে বলতে ভুল করবেন না।
ফিজিওথেরাপি:-
ব্যায়াম
কোমর ব্যথার চিকিৎসার মূল লক্ষ্য হলো ব্যথা নিরাময় করা এবং কোমরের নড়াচড়া স্বাভাবিক করা। পূর্ণ বিশ্রাম কিন্তু দীর্ঘদিন বিশ্রাম নিলে ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যায়। তীব্র ব্যথা কমে গেলেও ওজন তোলা, মোচড়ানো পজিশন, অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম ও সামনে ঝুঁকে কাজ করা বন্ধ করতে হবে। সঠিক উপায়ে বসার অভ্যাস করতে হবে এবং প্রয়োজনে ব্যাক সাপোর্ট ব্যবহার করতে হবে/
কিছু ব্যায়াম কোমরব্যথা প্রশমনে সাহায্য করে, এমনকি ওষুধের চেয়েও ভালো ফল দেয়। এই ব্যায়াম প্রতিদিন রাতে ও সকালে বিছানায় শুয়ে শুয়ে করতে পারেন। সময় লাগবে সর্বোচ্চ ৭ মিনিট।
১. সমতল হালকা নরম বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে দুই হাত শরীরের দুই পাশে রেখে দুই পা সোজা করে শুতে হবে। হাঁটু ভাঁজ না করে এক পা ওপরের দিকে তুলুন যতদূর সম্ভব। ১০ সেকেন্ড পা তুলে রাখতে হবে। একইভাবে অপর পা ওপরে তুলুন এবং একই সময় নিন।
২. এবার একইভাবে হাঁটু ভাঁজ না করে একসঙ্গে দুই পা তুলুন এবং একই সময় নিন।
৩. এবার এক হাঁটু ভাঁজ করে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে হাঁটুকে বুকে লাগানোর চেষ্টা করুন।
১০ সেকেন্ড থাকুন। একইভাবে অপর হাঁটু বুকে লাগাতে হবে।
৪. একসঙ্গে দুই হাঁটু ভাঁজ করে দুই হাতে জড়িয়ে বুকে লাগাতে হবে।
৫. সর্বশেষ দুই পা সোজা করে পায়ের পাতার দিকে সটান করে ১০ সেকেন্ড রাখতে হবে।
প্রতিটি ধাপ ১০ সেকেন্ড দীর্ঘায়িত হবে বা ১০ গোনা পর্যন্ত করতে হবে।
ইলেকট্রোথেরাপি
, যেমন- ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন, আল্ট্রাসাউন্ড থেরাপি, লাম্বার ট্রাকশন, শর্টওয়েভ ডায়াথার্মি, অতিলোহিত রশ্মি, ইন্টারফেরেনশিয়াল থেরাপি, ইনফারেড রেডিয়েশন, ট্রান্স কিউটেনিয়াস ইলেকট্রিক নার্ভ ইস্টিমুলেটর, ইলেকট্রিক নার্ভ ও মাসেল ইস্টিমুলেটর, অটো মেনুয়াল ট্রাকশন, হাইড্রোথেরাপি, লেজার থেরাপি চিকিৎসা করা হয়।
সার্জারি : যদি দীর্ঘদিন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নেবার পরেও রোগীর অবস্থার পরিবর্তন না হয় রোগীকে অবস্থা অনুযায়ী কোমর-মেরুদন্ডের অপারেশন বা সার্জারির করনোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। সার্জারির পরবর্তীতে রোগীকে বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্টের নির্দেশ মতো নির্দিষ্ট ব্যায়াম দীর্ঘ দিন চালিয়ে যেতে হয়।